মিজান রহমান (এডিনবরা, স্কটল্যান্ড):
টিকরিয়া গ্রামেই আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। টিকরিয়া রাসুলজান আব্দুল বারী উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সুমন সরকার ।
ইদানিং ফেইসবুকে সুমন সরকারের একটি পোষ্ট ভাইরাল। কেউ কেউ বলছেন ধর্মকে আঘাত করে তিনি নাকি কি কি মন্তব্য করেছেন। আমি নিজে তার পোষ্টটি দেখিনি। তার পোষ্টের স্ক্রিন শট দেখেছি । কিন্তুু স্ক্রিন শটে ও পুরো মন্তব্য স্পষ্ট নয়। এই ঘঠনার পর ফেইসবুকে স্থানীয় তরুন সমাজের মধ্যে চরম উত্তেজনা। অনেকেই পুরো বিষয়টি ভালভাবে না বুঝে, সম্পুর্ণ না জেনে অন্যের মন্তব্যের রেশ ধরে উত্তেজনা মুলক মন্তুব্য ছড়িয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার হুমকি, ধমকি এবং অশ্লিল ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রতিবাদ সভায় যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ।
অনেকের দাবী তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহন, চাকুরীচ্যুতি ইত্যাদি ইত্যাদি..
বিষয়টির গভীরতা বুঝতে পেরে সুমন সরকার ক্ষমা চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন অতঃপর ফেইসবুক লাইভে এসে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে যখন লোকটি এতটুকু মহানুবভতার পরিচয় দিল তারপর এ নিয়ে বাড়াবাড়ি মোটে ও সমীচিন নয়। মহানুভবতার পরিচয় দেয়ার জন্য সুমন সরকারের প্রতি রইল ধন্যবাদ ও সাধুবাদ।
সাম্প্রদায়িক ইস্যু বড়ই নাজুক একটি বিষয়। এটা দিয়ে খুব সহজেই মানুষের আবেগকে উছলে দেয়া যায়। আমাদের টিকরিয়া গ্রামে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের শান্তিপুর্ন ভাবে সহাবস্থান করছে দীর্ঘ কাল থেকে। কখন ই কোন অপ্রীতিকর ঘঠনা ঘঠেনি।
সুমন সরকারে বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদে মুখর তারা ইসলামের প্রতি কতটা অনুগত সেটাই আমার প্রশ্ন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আসলে ইসলাম কি বলে, সেটা কি তারা একবার ভেবে দেখেছেন ? প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বর্তমানে যেভাবে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে , অশ্লিল ভাষা ব্যাবহার করা হচ্ছে এটা কি কোনভাবেই কি কোন ধর্ম সমর্থন করে ? ইসলামের প্রতি অত্যাধিক দরদ দেখাতে গিয়ে আমাদের ধর্মের বারটা বাজাচ্ছে কে বেশী ?
সুমন সরকারের পোষ্টে কি ছিল ?
সুমন সরকার পোষ্টটি ভালভাবে পর্যবেক্ষন করলে যা দেখা যায় তা হচ্ছে তিনি একটি নিউজের লিংক পোষ্ট করেছেন এবং উক্ত নিউজে প্রকাশিত একটি ভাংচুরের ছবি। নিউজ টি সিলেটের বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল এবং ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয় ( নিউজ লিংক ) । নিউজটি ছিল ‘মসজিদের মাইকে ঘোষনা দিয়ে হিন্দুবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর‘ । ঘঠনাটি ঘঠে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে গোলাপগঞ্জের বারকোট গ্রামে। কিন্তুু ৩ বছরের এই পুরনো নিউজটি হুবহু ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ও একাধিক অনলাইন পোর্টাল প্রচার করে।
এর পিছনে ও রয়েছে বিভিন্ন কারন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি মহল সবসময় থাকে তৎপর। অবাধ তথ্য প্রবাহের সুবাদে ফেইসবুকের মাধ্যমে সুমন সরকার সহ আরও অনেকের নজরে আসে সংবাদটি। সাম্প্রতিককালে প্রিয়া সাহার ঘঠনার কাউন্টার হিসাবে এই নিউজটিা শেয়ার করাটা তার কাছে মনে হয়েছে যৌক্তিক। পোষ্টে তিনি পরোক্ষভাবে খারাপ ভাষা ব্যাবহার করেছেন। সুস্পষ্ট ভাবে তিনি কোন ধর্মের নাম ব্যাবহার করেননি। সুমন সরকার যে লিংকটি শেয়ার করেছেন সেঠা ছিল সিলেট টুডে ২৪ নামক পোর্টালের একটি নিউজ উক্ত নিউজটি ভালভাবে পড়লে যা জানা যায় তার সারমর্ম হচ্ছে, ঢাকা দক্ষিনের বারকোট গ্রামের জনৈক আকবর আলী গংদের সাথে তার প্রতিবেশী নগেন্দ্র দেবের ছেলে রিপন দেবের জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল ১২-১৩ বছর যাবত। একটি মামলা ও চলমান রয়েছে। রিপন দেবের অভিযোগ আকবর আলী তার জায়গা দখল করে নিয়েছেন। এ ঘঠনায় অতীতে একটি খুন ও হয়েছে। ঘঠনার দিন আটো চালক আকবর আলী সাথে রিপন দেবের কথা কাটাকাটি হয় এবং ঢিল ছুড়াছুড়ি হয়। ঘটনারস্থল ছিল মসজিদের নিকটবর্তী। আকবর আলীর ভাষ্যমতে তখন মসজিদে যাচ্ছিলেন। রিপন দেব তাকে মারতে চেয়েছিল কিন্তুু মসজিদে ঢুকে যান তাই মারতে পারেনি। ঢিল যেহেতু আকবর আলী কে ছুড়া হয়েছিল এবং আকবর আলী তখন মসজিদের পাশে ছিলেন তাই ঢিলটি হয়তবা মসজিদে ও পড়তে পারে।
আকবর আলী তার সাথে ঘঠে যাওয়া এই ব্যাক্তিগত বিরোধটিকে সুকৌশলে মসজিদের সাথে যুক্ত করে ফেলেন। এক সময় ঘঠনাটি এমনভাবে সাজানো হয় যে, রিপন দেব মসজিদে আগত কাউকে কিংবা মসজিদে হামলা করেছে। ব্যাস, এটা রুপ নেই একটি সাম্প্রদায়িক ঘঠনায়। ঘঠনার প্রতিবাদে মিটিং ডাকা হয় এই মসজিদে। মিটিং এর প্রচারনা চালাতে ব্যবহার করা মসজিদের মাইক। দুই তিনশ লোক জড়ো হন মিটিংয়ে। বিষয়টি হয়ে ওঠে হিন্দু কতৃক মসজিদে হামলার প্রতিবাদ। এর সাথে ইন্দন যোগান স্থানীয় প্রভাবশালী বিএনপি নেতা যিনি চেয়ারম্যান ইলেকশন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মিটিং চলাকালে আকবর আলীর সমর্থকরা ধর্মের আবেগকে পুজি করে হামলা চালান রিপন দেবের বাড়িতে। বিষয়টি আর ব্যাক্তিগত বিরোধ না থেকে, এটা হয়ে ওঠে ধর্ম রক্ষার সংগ্রাম। ওদিকে কাটতি পাওয়ার আশায় অপসাংবাদিকতায় পুষ্ট কিছু অনলাইন পোর্টাল হেড লাইন করে ‘মসজিদের মাইকে ঘোষনা দিয়ে হিন্দু বাড়িতে হামলা‘ । এবার দেখুন ব্যাক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিভাবে মানুষ ধর্মকে জড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে।
এই ঘঠনার সংবাদটি পড়ার পর সুমন সরকার এর সুত্রের সত্যতা যাচাই কিংবা বিশ্লেষন করার কোন তাগিদ অনুভব করেননি। তার কাছে মনে হয়েছে প্রিয়া সাহার ইস্যু যখন ভাইরাল তখন ৩ বছরের পুরনো সংবাদটি মোক্ষম ডিফেন্স। সাধারন মানুষের পক্ষে সংবাদের সত্যতা যাচাই না করাটাই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র জার্নালিজম সংক্রান্ত বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকরাই এ ধরনের বিশ্লেষন করতে সক্ষম। ফেইসবুকে এরকম শত শত ভুয়া তথ্য অহরহ মানুষকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন জরিপ ও গবেষনা বিশ্লেষন করলে এই বিষয়টা স্পষ্ট ভাবে প্রতিয়মান হয় যে, বেশীর ভাগ ঘঠনাই ব্যাক্তিগত বিরোধ। যেহেতু এক পক্ষ হিন্দু এবং অন্যপক্ষ মুসলিম তাই বিষয়টি পরিসংখ্যানে ওঠে আসে ‘বর্ণবাদী ঘঠনা‘ হিসাবে। যে কোন খুন, ধর্ষন জাতীয় ঘঠনায় যখন ভিকটিম সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের হবেন তখন তা পরিসংখ্যানে যুক্ত হবে সংখ্যালঘুর উপর হামলার কলামে। পুলিশের কাছে ২০১৮ সাথে দায়ের করা অভিযোগের হিসাবে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ১৩ জন মহিলা/শিশু ধর্ষিত হন। এটা বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যা। দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে এখানে হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজন অর্ন্তভুক্ত হবেন। এখানে ভিন্ন ধর্মমত পোষন করার জন্যই ধর্ষিত হচ্ছেন এটা বলা সমীচিন নয়। যে সব সংস্থা, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের মুল লক্ষ্যই হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্গনের বিষয়গুলি সুচারুভাবে রেকর্ড করা।
আমার লেখায় সংযুক্ত দুটি উদাহরন তার প্রমাণ। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হচ্ছে না এটা কিন্তুু বলছি না। আমার কথা হচ্ছে, ঘঠনার মোটিভ গুলি সবসময় ধর্মবিশ^াস নয় । ঘঠনার পিছনে থাকা অন্য যে কোন মোটিভ কে ধর্মের সাথে জুড়ে দেয়া হয় ব্যাক্তিস্বার্থে। বাংলাদেশ কেন, বিশে^ এমন একটি দেশ খুজে পাওয়া যাবে না যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর নির্যাতন হচ্ছে না। কোন না কোন ভাবে সংখ্যালঘু রা সমান সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তুলনামুলক ভাবে, পরিসংখ্যান অনুযায়ী চাকুরীর ক্ষেত্রে মাইনোরিটির অংশগ্রহন ব্রিটেনের চেয়ে ও বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে আছে।
শ্রীমঙ্গলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: ফিরে দেখা
এক্ষেত্রে আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘঠনা উল্লেখ করছি। ৯০ এর দশকে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে দেশের মুসলিম সমাজ প্রতিবাদ মুখর। এসময় শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় কয়েকটি সংঘঠন মিলে একটি প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করে। মিছিলটি শুরু হয় কলেজ রোডস্থ জামে মসজিদ থেকে। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি ও ছিলাম সেই মিছিলে। যেহেতু বিষয়টি ছিল ইমোশনাল তাই সেদিনের মিছিলে মানুষের অভাব হয়নি। দল মত নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক যোগ দেন ঐ মিছিলে। কলেজ রোড় থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে চৌমুহনা অতিক্রম করে হবিগঞ্জ রোড থেকে বায়ে মোড় নিয়ে পুরান বাজারের দিকে ঢুকে। ঠিক এই সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুক্রবার থাকায় অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। মিছিলটি যখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখনই ঘঠে মুল ঘঠনাটি। পুরান বাজারের রাস্তার দুইপাশে অধিকাংশ দোকানপাট হচ্ছে হিন্দু মালিকানাধিন।
দীর্ঘ মিছিলের অগ্রভাগ পোষ্ট অফিসের প্রায় কাছাকাছি। মিছিলটি টেলিফোন্ এক্সচেঞ্জ অতিক্রম করার পর পরই হঠাৎ সামনে থেকে কে একজন চিৎকার করে বলল মিছিলের উপর বাম পাশ থেকে কেউ একজন ঢিল ছুড়ে মেরেছে। ঢিলে আহত কিংবা আঘাতপ্রাপ্ত কাউকেই কিন্তুু দেখা যায়নি। ঢিলটি ছুড়তে ও কেউ দেখেনি। এমনকি আমি নিজে ও দেখিনি। রাস্থার উভয় পাশেই যেহেতু হিন্দু মালিকানাধিক কাপড়ের দোকান তাই উত্তেজিত জনতার অনেকেরই ধারনা হিন্দুদের কেউ হয়ত এটা করেছে। সত্যিকার অর্থে কেউ ঢিল ছুড়েছিল কিনা – কিংবা ঢিল ছুড়ে থাকলে কে ছুড়েছে সেটা বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে বলে কেউ চিন্তা করেনি।
মিছিলের উপর হিন্দুরা ঢিল ছুড়েছে – এই আওয়াজটি দেয়ার সাথে সাথেই উত্তেজিত ‘তৌহিদী জনতা‘ পাশের দোকানগুলিতে ভাঙচুর শুরু করে দেয়। পুরো মিছিলটি এভাবেই পন্ড হয়ে যায়। আয়োজকদের মধ্যে যেসব সচেতন আলেম ওলামা ছিলেন তারা অনেক চেষ্টা করে ও কাউকে দমাতে পারেন নি সেদিন। যেহেতু মিছিলের আয়োজক নির্দিষ্ট ভাবে একক কোন সংঘঠন কিংবা গ্রæপ ছিল না । এতে যোগ দেয়া উত্তেজিত জনতা তাদের ভিতরে যে ক্ষোভ ছিল তা প্রশমনে বিরামহীন ভাবে ভাংচুর চালাতে থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরজুড়ে। শুরু হয় তান্ডব। আমরা পোষ্ট অফিস রোড হয়ে চৌমুহনায় আসার পথে দেখতে পাই বিভিন্ন দোকান ভেঙ্গে লোকজন কিভাবে লুটপাট চালাচ্ছে। বিশেষ করে পুথিঘর লাইব্রেরী এবং সত্য বাবুর হার্ডওয়ার দোকানের শাটার ভেঙ্গে কিছু লোক দোকানের মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। পুরো শহর পরিণত হয় একটি রণক্ষেত্রে।
ওইদিন রাতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাঙচুরের খবর আসতে লাগল। চোর এবং খারাপ মানুষগুলি এই সুযোগে তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থে ঝাপিয়ে পড়ে। মন্দির গুলিতে অতি মুল্যবান ধাতব পদার্থের মুর্তি রয়েছে এমন বিশ^াসে চোররা টার্গেট করে অধিকাংশ হিন্দু মন্দির।
হামলাকারী দের অনেকের চেহারা স্পষ্ট মনে আছে। কারো নাম উল্লেখ করা যথার্থ হবে না। যারাই ন্যাক্কারজক কাজগুলি করেছেন তাদের কাউকেই কোনদিন মসজিদের আশেপাশে দেখা যেত না। এদের মধ্যে ছিল না ধর্মীয় কোন অনুশাসন। কিন্তুু সেদিন তারাই ছিলেন ধর্মের প্রতি সবছেয়ে বেশী দরদী। এই ঘঠনায় অবশ্য স্থানীয় একটি রাজনৈতিক মহল ফায়দা লুটে।
টিকরিয়া গ্রামে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান: ফিরে দেখা
আমার জন্মভুমি শ্রীমঙ্গলের এই টিকরিয়া গ্রাম। চা-বাগান ও বালিশিরা পাহাড় উপত্যকার একটি শ্যামল জনপদ। অবস্থানগত কারনে টিকরিয়া গ্রামে নানা ধর্মের/বর্ণের মানুষের বাস। নানা ভাষাভাষী শিশুদের সাথে মিলে মিশে আমার বেড়ে ওঠা। প্রাইমারী শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে টিকরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রায় অর্ধেক ছাত্র ছিল মণিপুরী সম্প্রদায়ের এবং বাকীরা অর্ধেকের মধ্যে ছিল হিন্দু, মুসলিম ও চা বাগানের শ্রমিক সম্প্রদায়- যারা মুলত উড়িষ্যার মানুষ, ভাষাগত ভাবে সম্পুর্ণ আলাদা। এছাড়া মণিপুরী ভাষা বাংলা থেকে সম্পুর্ণ পৃথক। আমাদের শ্রদ্ধেয় মরহুম কাইউম স্যার ক্লাসে প্রায়ই মণিপুরী ছাত্রদের তাদের ভাষায় কোন টাকে কি বলে তা জিজ্ঞাসা করতেন। স্যার প্রায়ই মণিপুরী ভাষায় ওদের সাথে কথা বলতেন। স্যারের এসব কথোপকথন শুনতে শুনতে মণিপুরী ভাষার উপর আমাদের দখল ছিল বেসিক লেভেলের । আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে ডাক্তার আব্দুস ছামাদ সাহান, জহির ও মৌলা (আমেরিকা প্রবাসী), দিলু (ইটালী প্রবাসী), সুব্রত, সুদাম ও সজল সহ আর ও অনেক রয়েছেন । এক সময় আমরা নিজেদের মধ্যে মণিপুরী ভাষায় কথা বলতাম।
আমাদের গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এত সুন্দর সহাবস্থান আমি পৃথিবীর কোথায় ও দেখিনি। কর্মসুত্রে প্রায়শই আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা গুলি বিভিন্ন সেমিনার ও মিটিং শেয়ার করি। পেশাগত ভাবে আমার মুল কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন বর্ণের, ধর্মের, জাতিস্বত্তার মানুষের মধ্যে সমানঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানা কর্মপšহা ও কর্মসুচী বাস্তবায়ন করা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্কটল্যান্ডে সাদাদের চেয়ে অন্যন্য জাতিগোষ্টির লোকজন সামাজিক, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক দিক অনেকখানি পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্চ। সমাজের সব ধরনের মানুষের মধ্যে সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে এ দেশের সরকার অঙ্গিকারবদ্ধ । তাই সরকারের অর্থায়নে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টি কে কিভাবে মুলধারার সাথে যুক্ত করা যায় সেঠা নিশ্চিত করাটাই আমার মুল কাজ বা চাকুরী। অশেতাঙ্গ লোকজন নানা কারনে বৈষম্যের শিকার হন। ব্রিটিশ সমাজে বর্ণবাদ একটি মারাত্বক সমস্যা। এশিয়ান বংশোদ্ভুত মানুষ সাদা দের চেয়ে কম অর্থ উপার্জন করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত জরীপে দেখা গেছে, বাংলাদেশী ও অন্যান্য সাউথ এশিয়ান মহিলাদের ৪৭ % চাকুরীর ইন্টারভিউ দেয়ার সময় বর্ণগত কারনে বৈষম্যের শিকার হন। আমি যে সব তথ্য উপাত্ত দিচ্ছি এগুলো স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো নয়। এদেশের মন্ত্রি, এমপি দের জনসমক্ষে চ্যালেঞ্জ করতে এসব পরিসংখ্যান আমাকে প্রায়ই উপস্থাপন করে হয়।
পরিশেষে, টিকরিয়া গ্রামের অতীতের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে যুব সমাজের প্রতি আমার সবিনয় নিবেদন হচ্ছে, আবেগ কিংবা গুজবে কান না দিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারন এবং আর ও কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। যুব সমাজের আবেগ কে ব্যাবহার করে দুষ্ট প্রকৃতির লোকজন যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সেদিকে নজর দেয়া দরকার। আজ বিশে^র বিভিন্ন দেশে মুসলমান রা নির্যাতিত হওয়ার মুল কারন কি ? মুসলমান দের সবছেয়ে বেশি ক্ষতি করছে কারা ? ধর্মীয় অনুশাসন আমাদের সমাজে কতটুকু প্রতিষ্টিত ? একটা ওয়াজ কিংবা সমাজসেবা মুলক ভাল কাজের উদ্যোগ নিলে মানুষের কাছ থেকে কতটুকু সাড়া মিলে ? অন্যদিকে সুমন সরকার জাতীয় ইস্যুতে কত সহজেই না মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে। ধর্মহীনতা যখন সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান তখন একজন মুসলমান হিসাবে কোন কোন বিষয়গুলি সবার আগে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। বর্তমান যুগের যুব সমাজ অতীতের চেয়ে অনেক সচেতন এবং আধুনিক। তারা চাইলে তথ্য প্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সঠিক ইসলামী মুল্যবোধ প্রতিষ্টায় যথেষ্ট ভুমিকা রাখতে পারে। সবকিছুর আগে যা করতে হবে তা হচ্ছে ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন। জানার পথ এখন অবারিত। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা নামক ক্যানসারের হাত থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে ইসলামের মুলবাণী ভালভাবে রপ্ত করতে হবে। সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে আমাদের নতুন প্রজন্ম যথাযথ ভুমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস ।
মিজান রহমান, এডিনবরা ২৬ শে জুলাই ২০১৯