বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমাদের ওয়েবসাইটে স্বাগতম (পরীক্ষামুলক স¤প্রচার)

স্কটল্যান্ডে করোনা ভাইরাস (বিস্তারিত)

সূর্য দীঘল ঘর




বাংলা স্কট নিউজ , এডিনবরা (৭ মে ২০২০)

সূর্য দীঘল ঘর (ছোট গল্প) লিখেছেন খেয়া পারের তরণী

আবার তারা ভিটেয় ফিরে আসে। পেছনে রেখে আসে নগরের ক্লান্ত জীবন। অনেক আশা, অনেক ভরসা নিয়ে তারা ভিটে ছেড়ে শহরের বুকে পা বাড়িয়েছিল, তবু আধুনিকতার স্বাদ অতৃপ্তই রয়ে গেলো। জীবনের এ লড়াইয়ে জয়নাব হেরে গেলো। অর্থের প্রাচুর্যতা ছাড়া রাজধানীর জীবন বড়ই ফিকে, ‘দিন আনি দিন খাই’ – এভাবেই চলছিল ওদের সংসার। বিশ্বাস ছিল কোনো না কোনোদিন স্বচ্ছলতা আসবে, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, মেয়েরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে, কিন্তু খোদা বড় অসময়ে জয়নাবের স্বামীকে ওপারে নিয়ে গেলেন। স্বল্পশিক্ষিতা জয়নাব বুঝলো স্বচ্ছলতা কোনোদিনই আর আসবে না, শহুরে জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলো তার স্বামীর সাথেই ফানুস হয়ে উড়ে গেছে। অগত্যা দুটি মেয়ের হাত ধরে সদ্য বিধবা জয়নাব ফিরে আসে সেই পুরান ভিটায়।

শ্বশুরের ভিটে, আর দীর্ঘদিনের আটপৌড়ে জীবনটাকে বিদায় দিয়ে একসময় জয়নাব স্বামীর হাত ধরে ঢাকায় পাড়ি জমায়। রাজধানির ছন্নছাড়া জীবনটা ভাল লাগেনি জয়নাবের। তবু মেয়েদুটোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওরা স্বামী-স্ত্রী সব কষ্টই মেনে নিয়েছিল। জয়নাবের শ্বশুরের ভিটায় আধাপাকা কয়েকটা ঘর, এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছে জয়নাবের মেয়েদের, ওদের অনেক স্মৃতি এই বাড়ির আনাচে কানাচে। কতদিন সে চেয়েছে সামনে বাগান ওয়ালা এমন একটা বাড়িতে থাকতে, কিন্তু এই ফিরে আসাটা অনেক কষ্টের। দীর্ঘদিনের শহুরে অভ্যস্ততার ইতি টেনে একটা আশায় ভর করে জয়নাব ফিরেছে, কারণ এই ভিটের ৮ শতকের উত্তরাধিকারী জয়নাবের স্বামী হাসান। মেয়ে দুটোকে মানুষ করতে এই ৮ শতক জমি আর আধাপাকা ঘরগুলোই এখন একমাত্র সম্বল।

আশেপাশের বাড়ি গুলোর চেয়ে এই ভিটের জমি অনেক উঁচু। স্বামীর কাছ থেকে শুনেছে জয়নাবের শ্বশুর জমিটা অনেক উঁচু করেছেন যাতে বন্যার পানি আসতে না পারে। জয়নাবের দাদী শাশুড়ি মারা যান বানের পানিতে ভেসে আসা সাপের কাঁমড়ে, জয়নাবের শ্বশুর তখন অনেক ছোট। ৮৮’ সালের  বন্যার সময় গ্রামের বানে ভাসা মানুষদের আশ্রয়ের জন্য জয়নাবের শ্বশুর মূল বাড়ীটার পেছনে দুটি ঘর তোলেন, সামনে টানা বারান্দা। একটা ঘরে পুরুষ অন্যটাতে মহিলা ও শিশুরা মাস তিনেক আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে। কিন্তু ঘরটা পূর্ব-পশ্চিম মুখী হওয়ায় পরবর্তীতে বসবাসের জন্য ভাল ঠেকল না। দেয়ালের নোনা আর বদ্ধ ভ্যাপসা গরমে কোন ভাড়াটিয়াই টিকল না। মাঝে মধ্যে  গ্রামের আত্মীয়-পরিজন আসলে ঘরদুটো ব্যবহার হতো, তাছাড়া বাকি সময় পুরানো আর অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়েই তালাবদ্ধ থাকত। শাশুড়ির ইন্তেকালের পর থেকে ভিটের মুলবাড়ির পুরোটা জুড়েই এখন জয়নাবের দেবর হোসেনের সংসার। দেবরের সংসারে উদ্বাস্তু না হয়ে পেছনের ওই পূর্ব-পশ্চিমমুখী সূর্যদীঘল ঘরদুটোতেই জয়নাব শুরু করে তার বিধবা জীবন।

জয়নাবের আয় বলতে বাপের বাড়ির ফসলের ভাগ তথা বছরে সামান্য কিছু টাকা, একটা ছোট-খাটো চাকরি জোগাড় করা খুব জরুরি হয়ে ওঠে। এভাবেই বছর গড়ায়, জয়নাব কাছের একটা এনজিওতে কাজ পায়। স্বামী বেঁচে থাকতে কখনও বাইরে কাজ  করেনি, অভাব অনটন থাকলেও কখনো চাকরি করার ইচ্ছা হয়নি। আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাশে ছুটতে হয় কাজে, নয়টা-পাঁচটা অফিস করে ছোট মেয়ে নাসকে পড়াতে হয়, খুব ক্লান্ত আর একা লাগে মাঝেমাঝে। বড় মেয়ে ফালাক খুব শান্ত, লেখাপড়ায়ও মাথা ভালো,  বাবার মৃত্যু কিছুতেই ও মেনে নিতে পারে না, মেয়েটা সারাক্ষন একটা অনিশ্চয়তায় ভোগে। মেয়েদুটোকে স্বাবলম্বী করাই এখন জয়নাবের একমাত্র লক্ষ্য। বড়মেয়েটা ভালো রেজাল্ট করে সামনের বছর ভালো কিছুতে ভর্তি হতে পারলেই অনেক দুশ্চিন্তা দূর  হবে। বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে মেয়েটার পড়ালেখার যে ক্ষতি হলো তা কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন লাগবে।

জয়নাবের বাইরে কাজ করা মেনে নিতে পারে না ওর দেবর হোসেন আর হোসেনের বউ। কোথায় বিধবা অবলা নারী মানুষের দয়া-মায়ায় দিন কাটাবে, তা না, বাড়ির বাইরে কোথায় কি করে বেড়ায় কে জানে। এই এলাকার মানুষের জয়নাবের উপর পুরানো রাগ, মেয়ে পড়ানোর জন্য এলাকা ছাড়লো! কেন, এই এলাকায় মেয়েরা লেখাপড়া করে না? কথা সত্য, কিন্তু এলাকার মেয়েদের মেট্রিক দিতেই বিয়ের পাত্র দেখা শুরু হয় আর কলেজে পড়তে পড়তে প্রায় সবার বিয়ে হয়ে যায়। জয়নাব এলাকা ছেড়েছিলো বড় মেয়েটার জন্য, স্কুলে যাওয়া-আশা অসম্ভব হয়ে যায় কিছু বেয়াদপ ছেলেদের জন্য। ওদের বাপ্-মা কে নালিশ করেও লাভ হয়নি বরং শুনতে হয়েছে অ্যাসিড খাওয়ার হুমকি। জয়নাবের স্বামী এরপর আর দেরি করেননি, কোনোমতে একটা চাকরি জুটিয়ে এলাকা ছেড়েছিলেন, কিন্তু এলাকার সবাই ঐ ঘটনা ভুলে গেছে। 

বাড়ির পাশেই একটা চায়ের টং, আর তার দশ গজ পরেই মসজিদ। মসজিদে নামাজ শেষ হলে মুসুল্লিরা বিকেলের চা পর্বটা এখানেই সারে, কেউ কেউ মাগরীবের নামাজ আদায় করে একবারে বাড়ি ফেরে। ঐদিন ছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে পাওয়া গেলনা কোন রিকশা, অগত্যা ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে জয়নাবের বাড়িফেরা। চায়ের টং ঘিরে মুসুল্লিদের ভিড়, জয়নাব কোন দিকে না তাকিয়ে হন হন করে বাড়ি ঢোকে। কিন্তু মুসুল্লিদের চোখ জয়নাবকে ঠিকই দেখে। বিধবা জয়নাবের এই বেপর্দা চলাফেরার কেচ্ছা ঈমাম সাহেবের কাছে যায়। জয়নাবের দেবরকে ঈমাম ডেকে বলেন তার ভাবি যেন পর্দা করে চলে। মসজিদের মুসল্লিরা সবসময়য় তাদের সম্মান করে কারন জয়নাবের স্বামী এই মসজিদে নিয়মিত নামায পড়তেন, জয়নাব যাতে স্বামীর সম্মানটুকু নষ্ট না করে। জয়নাবের দেবর এবার বলতে থাকে, “আব্বা বেঁচে থাকলে ওরে এই বাড়িতে উঠতেই দিতো না, ওই আমার ভালা ভাইটার মাথা থারাপ করছে, মেয়ে পড়াইব, মেয়ে পড়াইতে গিয়া ভাইটারেই খাইল”। ঈমাম সাহেব এবার আরেকটু সুযোগ পেলেন “তোমার বড় ভাইজির বিয়া দিয়া দাও, বয়সত হইছেই, তাইলে ওর খরচটাও কমবে, ঘরের বাইরে আর বেপর্দা কাম করতে হবে না তোমার ভাবীর। আমার কাছে ভাল পাত্র আছে, বিয়েতে কোন খরচ-পাতি লাগব না। দেখ, তোমার ভাবীরে বুঝাও। এরকম বেপর্দা চললে তোমার ভাইজিদের জন্য কোন পাত্রই পাওয়া যাবে না”।

ভাবি, ও ভাবি, একটু কথা ছিল। জয়নাব বারান্দার গ্রিল খুলে দেবরকে ঘরে নিয়ে আসে। ঈমামের কথার প্রসঙ্গ টেনে হোসেন বলতে থাকে তোমার একটু পর্দা করে চলতে হবে। পাড়ার মুসুল্লিরা আজেবাজে কথা বলে। ঈমাম সাহেব তো বললেন তোমার চাকরিটা ছাড়ায় দিতে,  আমি বলছি বড় মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত তোমার চাকরিটা দরকার। ঈমাম সাহেব বলছেন পর্দা করে চলতে যাতে কেউ খারাপ কথা না বলে। জয়নাব কোনো জবাব দেয় না। এবার চা চুমুক দিতে দিতে আস্তে আস্তে হোসেন বলে ঈমাম সাহেবের হাতে ভালো পাত্র আছে, তুমি চাইলে কথা আগাতে পারি।  জয়নাব এবার বলে “ওর বাপের ইচ্ছা ছিল মেয়েরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবে, তারপরে বিয়ে দিবে।  মানুষটা চলে গেছে কিন্তু মেয়েদুইটারে আমি যতটুকু পারি পড়াবো যাতে ওদের স্বামী মরলেও আমার মতো পানিতে না পরে।  ঈমাম  সাহেবরে বইলো আমাদের জন্য দোআ করতে।  তোমার ভাই পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তো, আমাদের জন্য পাড়ায় কোনো বদনাম হবে না। হোসেন আবার বলতে শুরু করে, “দেখো ভাবি, আমিতো ওদের বাপের মতো, ঈমাম সাহেবের কথাটা শুনো, ফালাকের বিয়েটা দিয়ে দাও, আমার দায়িত্ব একটু হালকা হবে”। ফালাক এসময় ঘরে ঢুকে এবং চাচাকে রূঢ়ভাবে বলে তার বিয়ে নিয়ে না ভাবলেও চলবে। চাচা কিছু বলার আগেই  ফালাক  বলতে থাকে “আপনি আমার আব্বা হলে আমাকে বোঝা ভাবতেন না, আমার আব্বা সারাজীবন চাইছেন আমরা যাতে মানুষের মতো বাঁচি, সেই চেষ্টা আমি করবো”। হোসেন এবার রেগে যায়, জয়নাবকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে, ” দেখবো, তোমরা কেমনে বাঁচার মতো বাঁচো, আজকে তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাও কারণ মহল্লার মানুষ জানে তোমরা আমার ভাইয়ের পরিবার, তুমি আর তোমার মেয়েরা যেই অপমান আমারে করলা তার শাস্তি তোমরা পাবা” ।

ঈমাম সাহেব হোসেনের কথা শুনে খুব নাখোশ হলেন কিন্তু কোনো ফতোয়া দিলেন না । হোসেন মনে মনে চাইছিল ঈমাম সাহেব যাতে ওদের এলাকা ছাড়ানোর ফতোয়া দেয়। ঈমাম সাহেব হোসেনের  মনের কথাটা জানতেন। হোসেনের ভাই হাসান মৃত্যুর আগে কোনো সম্পত্তির উইল করে যায় নাই । হাসানের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় ওই ভিটা বাড়ির সিকি ভাগ ছাড়া প্রায় পুরোটার ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী হোসেনের একমাত্র ছেলে ইমরান ।  জয়নাব আর ওর মেয়েরা এলাকা ছাড়লে ওই সিকি ভাগটাও হোসেন দখল করতে পারবে । ধর্মের অজুহাতে মানুষের এরকম লোভ এবং প্রতারণার সাথে ঈমাম সাহেব পূর্ব-পরিচিত। জয়নাবের স্বামী হাসান এলাকা ছাড়ার আগে ঈমাম সাহেবের সাথে দেখা করেন এবং তার হতাশার কথা জানান। ঈমাম সাহেবেরও মেয়ে আছে, পাড়ার বখাটেদের ধুমকি-ধামকিতে তার মেয়েকেও অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যবসত হাসান মারা যাওয়ায় তার মেয়েরা এখন এতিম, তিনি শরীয়া আইন মানলেও নাবালিকা এতিমদের হক ছিনিয়ে নেয়ার জন্য ফতোয়া দিবেন না। কিন্তু  হোসেনের মনে শান্তি নাই, ভাইজিদের অপমান আর পুরো ভিটে বাড়ি দখলের লোভ সারাদিন তাকে ভাবায়। হোসেন ঘোরের মধ্যে থাকে, খোঁদার কাছে অপমানের বদলা চায়।

বাড়ির পাশের ডোবাটা ভরাট করে জমির মালিক দালান তুলবে।  ইটের কোয়া আর পাথরের টুকরা স্তূপ করে দেয়াল দিয়েছে গেলো বছর কিন্তু দালান তোলা শুরু হয়নি এখনো । এই সুযোগে মুসল্লিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদ্রাসার ছেলেরা দেয়াল টপকে খালি জায়গায় নিরিবিলি ক্রিকেট খেলে । এই ছেলেগুলো খুবই গরিব পরিবারের সন্তান, পাঁচ টাকা দিলেই যে কোনো কাজ করে দিবে। হোসেন একদিন মসজিদে যাওয়ার পথে হাফেজি পড়ুয়া কয়েকটা ছেলেকে দেয়ালটা টপকাতে দেখে। পরেরদিন দুইজনকে রাস্তায় আটকে বলে,  ” তোরা যে লুকায় লুকায় ক্রিকেট খেলস আমি দেখসি, বড় হুজুররে বলে দেব, তারপর তোদের বেতের বাড়ি খাওয়াবো”।  ছেলে দুইটা ‘না চাচা, এরকম কইরেন না, আমরা আর খেলমুনা’  বলতে বলতে মাফ চাইতে থাকে । কয়েকবার মাফ চাওয়ার পরে হোসেন বলে, “আচ্ছা কমুনা, কিন্তু আমার একটা কাজ করতে হবে। যদি কেউ না দেখে তয় প্রতি শুক্রবার দুইজন পাঁচটাকা করে পাবি।  কিন্তু যদি কেউ দেইখা ফেলে তাইলে বড় হুজুররে কয়ে দিবো তোরা লুকায় ক্রিকেট খেলস”।  ৭/৮ বছরের গরীব মাদ্রাসাপড়ুয়া বালকদ্বয় বড় হুজুরের ভয়ে হোসেন যা বলে তাতে রাজি হয়ে যায় অকপটে।

“কামটা হলো ফজর আর মাগরীবের নামাজের পর ফালাকের বাড়ির চালে ঢিল মারবি। ফালাক, ওর বোন আর মা নামাজ কালাম পরে না, পর্দাও করে না, ওরা ভাববো নামাজী জীনেরা ঢিল মেরে ওদের ঘুম ভাঙ্গায় দিচ্ছে। কয়েকদিন এরকম কর দেখবি ওরা আল্লার পথে আসবে, পর্দা করবে, নামাজ পড়বে, আর তোরাও অনেক সওয়াব পাবি আখিরাতে”। ছেলেদুইটা বেতের বাড়ি আর পরকালের সওয়াবের আশায় রাজি হয়ে যায়। হোসেন বার বার সতর্ক করে দেয় কেউ যেনো টের না পায়।

ফালাক প্রতিদিন কলেজে যায় না, তাই রাত জেগে পড়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে। আসলে চাচার সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর থেকে ও এখন রাত জেগে মা আর বোনকে পাহাড়া দেয়। লোভ আর হিংসায় মানবতা যেনো বিলুপ্তির পথে এই জগতে, এই সূর্যদীঘল ঘরগুলো কি আসলেই ওদের অবলম্বন নাকি অভিশাপ? বাড়ির বারান্দায় একটা বাল্ব সারারাত জ্বলে কিন্তু ফালাক শান্তি পায় না, ওর মনে হয় কিছু একটা অশুভ এই ভিটের পূর্ব-পশ্চিমে অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনো একদিন সেই অশুভ শক্তি ওদেরকে  নি:শেষ করে ছাড়বে। ফালাকের এলোমেলো ভাবনাগুলোর রাতের আঁধারের মতোই অস্বচ্ছ, কিনতু প্রতিদিন ভোরের আলোয় ঢিল পড়ার ঘুট-ঘাট শব্দ ওকে আরো ভীত করে তোলে। জয়নাবও খেয়াল করে প্রায় প্রতিদিন মাগরীব আর ফজরের আজানের পরে কারা যেনো ঢিল ছোড়ে।  একদিন সকালে কলপাড়ে জয়নাবের সাথে ইমরানের দেখা হয়, ইমরান  মনোযোগ দিয়ে সাইকেল ধুচ্ছে।  চাচীকে দেখে হাসি দিয়ে বলে কেমন আছো চাচি? উত্তর দিয়ে জয়নাব বলে আমাদের চালে প্রতিদিন কারা যেনো ঢিল মারে, তুই একটু দেখিসতো, পোলাপান আজকাল বড়ো দুষ্টু হয়ে গেছে।  তুই ওদের পাইলে একটু মানা করে দিস, তোরা ছাড়া আমাদের কে আছে বল ? ইমরান বলে , ‘চাচী তুমি চিন্তা কইরো না, তোমার চালের ঢিলে আমারো ঘুম হয় না সকালে, আমি ওদের পাইলে আচ্ছা  মতো ধোলাই দিবো।  হোসেন  ঘর থেকে জয়নাব আর ইমরানের কথোপকখন শুনে।  পরের শুক্রবারে দুই মাদ্রাসার সৈন্যকে বলে ওদের ঢিলে কাজ হচ্ছে কিন্তু আস্তে আস্তে। হোসেন উপদেশ দিতে থাকে “এখন থেকে প্রতিদিন ঢিল না দিলেও হবে কিনতু যত বড় ঢিল তত বেশি সওয়াব; একবারে একটার বেশি ঢিল ছুড়বি না তাইলে ধরা পড়বি না;  আর বড় বড় ঢিল নিতে হবে যাতে একটাতেই দশটার সমান শব্দ করে” ; হোসেন আরো বলে, “একেকদিন একেক জায়গা থেকে ঢিল ছুড়বি যাতে ওদের মনে ভয় হয়, নামাজী জীন সব খান থেকেই ওদের দেখতে পারে”। ছেলেদুইটাও রাজি হয়, বেতের বাড়ি খাওয়ার চেয়ে একটু কষ্ট করে কয়েকদিন ঢিল ছুড়লে পরকালেও যদি সওয়াব পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কি?

ইমরান ছেলেটা বাবার ঠিক উল্টো, বাবা চায় ছেলে লেখাপড়ার ভাল করুক আর নামাজী হোক কিন্তু ছেলের আগ্রহ শুধু ক্রিকেট আর ফুটবল। নবীজির নিয়মে কয়েকবার কিশোর ইমরানকে মারতেও গেছেন কিন্তু ফল হলো উল্টো। ছেলের মাও ছেলের পক্ষ নিল ফলস্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর কয়েকদিন কথা বন্ধ। ঈমাম সাহেবের কাছেও ছেলেকে নিয়ে গেছেন, লাভ হয়নি। ঈমাম সাহেব বললেন ‘এখনকার ছেলেরা খুব আবেগপ্রবন ওদেরকে মহানবির (সঃ) যুগের মত শাসন করলে হবে না, ওদের সময় দাও। বাবামার দায়িত্ব বাবামাকে পালন করলে হবে, আল্লাহই একদিন ওদেরকে তাঁর পথ দেখাবেন। এরপর থেকে হোসেন ইমরানকে বিশেষ কোন শাসন করেন না, শুধু শুক্রবারের জুম্মায় ছেলেকে নিয়ে জামাতে যান। বাবা-ছেলের সম্পর্ক ওই সাপ্তাহিক জুম্মায় ঘুরপাক খায় কিন্তু সমস্যা হয় যখন ইমরান শুক্রবার বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ে অথবা শহরে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যায়। এরকম একটা শুক্রবারে ইমরান সাইকেল নিয়ে শহরে ম্যাচ দেখতে যায়, বাবাকে বলার সাহস হয় না, মাকে বলে সাতসকালে বেরিয়ে পরে। যথারীতি জুম্মা যাবার সময় ইমরানকে না পেয়ে হোসেন বউয়ের সাথে রাগারাগি করে। জুম্মা থেকে ফিরে আরেক ধাপ ঝগড়াঝাঁটি চলে, হোসেন নিজেকে ব্যর্থ মনে করে, কারন তার একমাত্র ছেলে এই বয়সে দিন দিন তার অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, হোসেন মাগরিবের নামাজের জন্য মসজিদে রওনা হয় আর ঠিক তখনি ইমরান বাড়িতে ঢোকে। ইমরানের সারা শরীরে কাঁদা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ম্যাচ দেখতে না বরং ম্যাচ খেলতে সারাদিন বাইরে ছিল। হোসেন বাড়ির উঠানেই ছেলেকে বকাঝকা করে মারতে উদ্ধত হয়, বরাবরের মত ইমরানের মা ঢাল হয়ে ঠেকায় ।  মাগরিবের আযান হয়ে যাওয়ায় “তোমার আশকারায় ছেলেটা দিন দিন বেয়াদপ হচ্ছে”, এই বলে হোসেন হনহন করে মসজিদের দিকে রওনা হয়।

হোসেন বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্রই মা ইমরানকে কসে একটা চড় দেয় আর বলে “আর দুইটা মিনিট পরে বাড়ি ঢুকলে কি হইত তোর, বাপরে চেতায় কি আনন্দ পাস?” এরপর ইমরানকে টানতে টানতে কলপাড়ে নিয়ে যায়। “নিজে পরিষ্কার হ, সাইকেল পরিষ্কার কর, তারপর ঘরে ঢুকবি” । চেঁচামেচি শুনে জয়নাব আর ফালাক কলপাড়ে চলে আসে ইমরান সবার দিকে মিটিমিটি তাকায় আর মিছিমিছি হেসে গায়ের কাঁদা ধুঁতে থাকে । ইমরানের মা কল চাপতে চাপতে জয়নাবকে পুরো ঘটনা বলে, এরপর ইমরানকে উদ্দেশ্য করে বলে “মাগরীবের আজান শুনছোস, তুই জানিস তোর বাপ্ এখন মসজিদে যাবে, আর পাঁচটা মিনিট পরে ঢুকলে কি হইত? তোর বাপ যেই চেতছে, আজকে তোর খবর আছে” । এসময় পশ্চিম আকাশের লালিমা ভেদ করে হঠাৎ কোথা থেকে একটা কংক্রিটের দলা এসে সজোরে আঘাত করে ইমরানের কপালে। কিছু বুঝে উঠার আগেই কলপাড়ে লুটিয়ে পরে ইমরান । ফালাক প্রাচীরের কাছে গিয়ে চিৎকার করে “কৈ তোরা, মানুষ মেরে ফেল্লি, কৈ তোরা সামনে আয়”। ওইদিকে মা-চাচির কান্নায় ফালাক আর নাস ছুটে আসে কলপাড়ে। ইমরানের মা ছেলের রক্ত দেখে জ্ঞান হারায়, জয়নাব শাড়ির আচল দিয়ে  ইমরানের ক্ষত চেপে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় ফালাক আর নাস দিশেহারা হয়ে প্রতিবেশীদের ডাকতে থাকে, ফালাক গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ইমরানের মাথায় তোয়ালে চেপে রক্ত থামানোর বৃথা চেষ্টা করতে থাকে।  

নামাজের সিজদায় হোসেনের  চোখ ভারী হয়ে ওঠে কান্নায় । নামাজ শেষে হোসেন দীর্ঘ মোনাজাতে বসে, নিরবে হাউমাউ করে আল্লাহর কাছে রহমত করুনা করে, আল্লাহ যেন ইমরানকে বিপথ থেকে ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনেন। মোনাজাত শেষ হতে না হতেই শুরু হল হট্টগোল। প্রতিবেশী একজন এসে বলল ভাই তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। হোসেন বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেশ করে, ‘ক্যান কি হইছে?’ প্রতিবেশী উত্তর দেয়, ‘জানি না, তুমি বাড়ি যাও তাড়াতাড়ি’। মসজিদের সিঁড়ির গোড়ায় প্রতি শুক্রবারের মত দাঁড়িয়ে আছে হোসেনের দুই সৈন্য, হোসেন পকেটে হাত দিয়ে দুইটা পাঁচ টাকার নোট বের করে। কাছে আসতেই  হোসেন দেখে ছেলে দুটোর চোখে পানি, ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় একজন বলে চাচা আমাদের মাফ করে দিয়েন। এবার হোসেন যেন পাথর হয়ে যায়, পা হিমশীতল, কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না। বাড়ীর কলপাড়ে প্রতিবেশীদের জটলা, জয়নাবের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ইমরান, রক্ত আর রক্ত।  ফালাক আর নাস ইমরানের মাথায় তোয়ালে চেপে রেখেছে, অন্যপাশে এক প্রতিবেশী বাতাস দিচ্ছে ইমরানের সঙ্গাহীন মাকে।

এম্বুলেন্স আসতে আরও কিছু সময় লেগে গেল। সদরের হাসপাতালে একজন ডাক্তার পাওয়া গেল। রক্ত বন্ধ হল, কিন্তু ইমরানের জ্ঞান ফিরল না। ডাক্তার বললো, “এর বেশি আর কিছু এখানে করা যাবে না, যত দ্রুত পারেন ঢাকায় নিয়ে যান”। ফালাক বললো চাচা দেরি কইর না এখনি রওনা দিতে হবে। হোসেন এবার ভাইজির দিকে তাকায়, মেয়েটার জামায়, হাতে, মুখে  ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, “তোরে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি ঢাকা রওনা হব, তোর সামনে পরীক্ষা, এখানে সময় নষ্ট করিস না, বাড়ি যা” ম্লান কণ্ঠে হোসেন উত্তর দেয় । ফালাক এবার বলে “চাচা আমার বাপটারে বাঁচাতে পাড়ি নাই, ভাইটারে বাঁচাইতে দাও, এই দেখ আমার সারা শরীরে ইমরানের রক্ত”। হোসেন আর নিজেকে সামলাতে পারে না, ভাইজিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, “আল্লাহ আমারে ফকির করে দিল, তুই আমারে মাফ করে দে মা, আমারে মাফ কর, আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে ফিরায় দাও” ।

এম্বুলেন্সটা এগুতে থাকে ঢাকার পথে, ইমরানের সংজ্ঞাহীন দেহটায় কখনও জ্ঞান ফিরে পাবে কিনা হোসেন জানে না । আধাপাঁকা পূর্ব-পশ্চিমমুখী এই ঘরদুটো  দখলের অভিপ্রায় কখনো নি:শেষ করেছে রক্তের দৃঢ় বন্ধন, আবার কখনো ছিনিয়ে নিয়েছে কারো তরতাজা কৈশোর। হোসেনের বার বার তার ভাইয়ের মুখটা মনে হতে লাগে, খোঁদা কেন তাদের দুইভাইয়ের উপর এতো অবিচার করলেন? খোঁদার এই বিশাল দুনিয়ায় ভিটেবাড়ির ওই সূর্যদীঘল ঘরগুলো কেন এতো অভিশপ্ত? নিয়তির অভিশাপ কেন এতো কঠোর? এর উত্তর কারো জানা নেই। (সমাপ্ত )

(গল্পটি বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত)


বি:দ্র: এই ছোটগল্পটি ২০১৮ সালে বুয়েট এলামনাই ইউকে রিইউনিয়ন ম্যাগাজিন ‘কানেক্ট‘ এ প্রকাশিত হয়েছিল।

সম্পাদক: মিজান রহমান
প্রকাশক: বিএসএন মিডিয়া, এডিনবরা, স্কটল্যাণ্ড থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: