আত্মহত্যা বিষয়ে বাংলাভাষী পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ধারাবাহিক কলামটি লিখেছেন প্রসেফর সেজান মাহমুদ । তিনি ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার কলেজ অব মেডিসিন-এ সহকারী ডিন হিসাবে এবং মেডিকেল এডুকেশন বিভাগে প্রফেসর অব মেডিসিন হিসাবে কর্মরত। পাবলিক হেলথ বিষয়ক গবেষক, লেখক, গীতিকার, সুরকার ও কলামিষ্ট।
আত্মহত্যা কী ও কেন ? (১ম পর্ব)
সেজান মাহমুদ
বাংলা স্কট ফিচার (এডিনবরা, ০২ ফেব্র“য়ারী ২০১৯):
আত্মহত্যা হলো একজন ব্যক্তির সরাসরি ভায়োলেন্স বা অন্য উপায়ে নিজের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো। পৃথিবীতে প্রতি বছর ৮০০,০০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন। গত ৪৫ বছরের পৃথিবীব্যাপী ৬০% আত্নহত্যা বেড়ে গেছে। আত্মহত্যা সবচেয়ে বেশি হয় পূর্ব-ইউরোপীয় দেশগুলোতে। ছোট, বড়, ধনী, গবীর, ছেলে, মেয়ে, শাদা কালও বাদামি সকল গোত্রের মধ্যে আত্নহত্যার নজির দেখা যায়। তবে মূলত ১৫-২৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হলেও খুব পরিস্কার করে যতোটুকু জানা গেছে তাই-ই যথেষ্ট যে সুইসাইড একটি রোগ। একারণেরই বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী সকল মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যামূলক আচরণকে একটি রোগ হিসাবে মানসিক রোগের আকরগ্রন্থ “ডিএসএম-৫” এ অন্তর্ভূক্তির সুপারিশ করেছেন।
আত্মহত্যার রিস্ক ফ্যাক্টর কী কী? মনে রাখবেন রিস্ক ফ্যাক্টর মানে হলো এগুলো থাকলে আত্নহত্যা বেশি হয়।
১। আগে যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে
২। বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগ থাকা, যেমন, বাইপোলার, স্কিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি।
৩। ড্রাগ বা অন্যান্য নেশায় আসক্তি
৪। পরিবারের মধ্যে যদি আত্মহত্যার ইতিহাস থাকে
৫। ছোটবেলায় যদি কোন রকমের এবিউজের হিস্ট্রি থাকে।
৬। আত্মহত্যার উপায় হাতের কাছে থাকা (যেমন, ডাক্তারদের কাছে সহজেই ওষুধ থাকে যা দিয়ে আত্মহত্যা করতে পারে, কিম্বা যাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, আমেরিকায় প্রায় সকলের কাছে থাকে এইজন্য সুইসাইড বেশি হয়)
৭। বড় ধরণের স্বাস্থ্যগত রোগ, যেমন ক্যান্সার বা পেইন
৮। নিকটজন বা বিখ্যাত কেউ আত্মহত্যা করলে
৯। ১৫-২৪ বছর এবং ৬০ বা তারচেয়ে বেশি বয়স্ক হোলে।
সুইসাইড ব্রেইন কি? মানুষের মস্তিষ্কে থাকে নানান রকমের নিউরোট্রান্সমিটার বা এক ধরণের ক্যামিক্যাল। গাবা (GABA) হলো সেই রকম একটি যার কাজ মস্তিকের সামনের দিকের অংশ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, আপনি কী করবেন আর করবেন না তা নিয়ন্ত্রণ করা। গাবা অনেকটা ব্রেক সিস্টেমের মতো কাজ করে। অতিরিক্ত ভাবনা এলে, বা উলটাপালটা করতে চাইলে গাবা জানিয়ে দেয় যে ব্রেক ধরো। দেখা গেছে যারা বিষণ্ণতায় ভোগে তাঁদের এই গাবার কাজকর্ম এলোমেলো হয়ে যায়। এঁদের মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ধরেনের রিসেপ্টর থাকে। এভাবেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে ব্রেক নিতে পারে না এরা। আরও আছে সেরেটোনিন। তাহলে আত্মহত্যা এমন একটি রোগ যা নিয়ন্ত্রণ করতে সত্যিকারের ভাল ডাক্তার প্রয়োজন। তাই যদি ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা বা অন্য মানসিক রোগ থাকে তাহলে সেটার চিকিৎসা জরুরী। এখানে অনেকেই প্রশ্ন করেন যে বংশগত ব্যাপারটা কি? আসলে তেমন কোন জীন আবিষ্কৃত হয়নি, তবে এপিজিনেটিক, যার অর্থ হলো বাচ্চা যখন মায়ের পেটে তখন কী পরিবেশে মা থাকছেন সেগুলো প্রভাব বিস্তার করে।
তাহলে জানা যাচ্ছে যে জ্বর হোলে যেমন ওষুধ খাই বা ডায়াবেটিস হোলে যেমন সারাজীবন চিকিৎসা নিই, তেমনি যেকোন মানসিক রোগের জন্যেই চিকিৎসা নেয়া উচিত। মানসিক রোগীকে পাগল বলবেন না। গালি দেবেন না, তিরস্কার করবেন না, ব্যঙ্গ করবেন না। বরং সহমর্মীতার হাত বাড়িয়ে দিন। বিশ্বাস করুন আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে শুধু কথা বলে, পরামর্শ দিয়ে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছি অনেককে যারা আমার এই ফেসবুকেও আছেন বন্ধু হয়ে। আবার ছোটবেলায় হারিয়েছি চেনাজানা অনেক মানুষ কে। আপনিও পারেন আরেকজন কে বাঁচাতে। আসলে প্রতিটি মানুষই অপেক্ষা করে কেউ এসে তাঁকে বাঁচাক।
(চলবে…)