০২/১০/২০১৯:
বাচ্চারা কদিন ধরে খুব করে ধরেছে, ফুচকা খাবে। কোন রেস্টুরেন্ট এর ফুচকা নয়, রাস্তায় ভ্যান এ করে বিক্রি করে, সেই ফুচকা । ওদের বাবা বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করে না । রোজ নাকি হাজারটা জন্ডিস এর রোগী আসে তার চেম্বারে। তাই রাস্তার খাবার তো দূরের কথা, রেস্টুরেন্ট এর খাবারও তার পছন্দ নয়। অথচ বাচ্চারা বলছে, তারা স্কুলে চুপি চুপি ফুচকা খেয়ে দেখেছে, ওটা অনেক বেশি টেস্টি। ওদের কে বকাঝকা দিলেও, মন বলছে, কথাটা হয়তো মিথ্যা নয়। স্টুডেন্ট লাইফে আমি যখন যশোর থেকে রাজশাহী যেতাম, তখন ফেরির উপরে কয়েক দফা মুড়ি মাখা না খেলে, আমার চলতো ই না। সেই মুড়ি মাখার স্বাদ, এখনো আমার মুখে লেগে আছে । তাই ভাবলাম, একদিন ওদের কে সত্যি সত্যিই বাইরের ফুচকা খাওয়াবো। গতকাল হঠাৎ করেই সেই সুযোগটা হলো।
গতকাল ছুটির দিন ছিল। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলাম । এখানকার ভার্সিটিটা খুব সুন্দর । ক্যাম্পাসটাতে কেমন যেন একটা মায়া মায়া ভাব আছে। এত সবুজ, মন জুড়িয়ে যায়। ঘুরতে ঘুরতে এক কর্নারে চলে এলাম । এই জায়গাটাতে বেশ ভীড়। শুধু ভার্সিটির ছেলে মেয়ে নয়, বাইরের থেকে অনেকেই আমাদের মত ঘুরতে এসেছে। অনেক গুলো ফুচকার ভ্যান । ভ্যান গুলোর সামনে পিছনে চেয়ার টেবিল পাতা। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, যত ভীড় একটা দোকানেই। অন্য গুলোর চেয়ার ফাঁকা থাকা সত্বেও সবাই ঐ একটা দোকানেই ভীড় জমিয়েছে। অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। বাচ্চাদের কে বললাম, চল ঐটাতেই খায়। সবাই যেহেতু ঐটাতে খাচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় ঐটা ই ভালো । আমাদের কে দেখে ভার্সিটির একদল ছেলে মেয়ে টেবিল ছেড়ে দিল। বললো, ” আন্টি, আপনারা বসুন। আমাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতেই মজা লাগে। “
ফুচকা দিয়ে গেলো যে ছেলেটা, তাকে দেখে অবাক হলাম । ছেলেটা কে দেখে কোন রকম ভাবেই ফুচকাওয়ালা মনে হয় না । বরং উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে মনে হচ্ছে । ফুচকা খেতে অসাধারণ না হলে ও, বেশ ভালোই বলা যায়। বাচ্চারা ফুচকা খাচ্ছে। আমি মাঝে মাঝে দুই একটা মুখে দিচ্ছি। কেন জানি, চোখটা ঘুরে ফিরে ছেলেটার দিকে যাচ্ছে ।
যে ছেলে মেয়ে গুলো আমাদের কে টেবিল ছেড়ে দিয়েছিল, তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েই আড্ডা দিচ্ছিলো আর ফুচকা খাচ্ছিলো। আমার পাশে দাঁড়ানো যে ছেলেটা, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ” এত দোকান থাকতে, সবাই এই দোকান থেকেই খাচ্ছে কেন ? ” ও ফুচকা ওয়ালা ছেলেটার দিকে হাতের ইশারা করে বললো, ” আনান কে সহযোগিতা করার জন্য । ” মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল । বললাম, ” ওর বুঝি বড় কোন অসুখ ধরা পড়েছে ? ” ছেলেটি হেসে দিয়ে বললো, ” না না, ও একদম সুস্থ । সত্যি কথা বলতে কি, ওর মত সুস্থ মানুষ এ সমাজে কয়জন ই বা আছে ? ” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ” মানে ? ” ছেলেটা বলতে থাকলো,
– আনান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র । ফিজিক্স এ পড়ে। ওদের ইয়ার এর ফার্স্ট বয়। প্রতিটা পরীক্ষাতেই ফার্স্ট হয়। প্রথম বর্ষ থেকেই ও প্রাইভেট পড়াতো। প্রাইভেট পড়ানোর টাকা গুলো জমিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছে। আমরা খুবই অবাক হয়েছিলাম। কারণ যতই গরীব হোক, প্রাইভেট পড়িয়ে ই তো নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করতে পারতো ? প্রথমে সবাই খুব ছি ছি করছিল। কিন্তু আনান এর বাবা যেদিন ক্যাম্পাস এ আসলো , সেদিন ই কানাঘুষায় কথাটা ছড়িয়ে গেল। আনান মোটেও গরিবের ছেলে নয়। ওর বাবা একজন সচিব !! আনান তার একমাত্র সন্তান । আনান ক্যাম্পাস এ ফুচকা বিক্রি করছে ! কেউ একজন কথাটা লাগিয়েছিল তার বাবার কানে। ওর বাবা কথাটা বিশ্বাস করে নি। কারণ প্রতি মাসে ই ছেলেকে তিনি পর্যাপ্ত টাকা দেন। তবে কি ছেলে নেশা করছে ?! ছুটে এসেছিলেন তিনি । ছেলে কে হাতে নাতে ধরে ফেললেন, ফুচকা বেচা বিক্রি করার সময় । আনান ভয় পেয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাবা কে জানালো তার ফুচকা বিক্রির কারণ।
কথা গুলো এক নাগাড়ে বলে ছেলেটা দম নিলো। আমার তখন তর সইছে না। একজন সচিব এর ছেলে কী কারণে ফুচকা বিক্রি করবে ? অধৈর্য হয়ে বললাম, ” ফুচকা বিক্রির কারণ কী ? ” ছেলেটা বললো, আনানের সাথে ছোট ছোট তিনটা ছেলে কে দেখতে পারছেন ? দেখলাম ছোট ছোট তিনটা ছেলে ওকে সাহায্য করছে। দুজন বসে বসে ফুচকা বানাচ্ছে আর একজন টেবিলে টেবিলে এবং দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের ফুচকা সার্ভ করছে। বললাম, ” হু ” । ছেলেটা আবার বলা শুরু করলো,
– তিনটা ছেলেই প্রতিবন্ধী । যে ফুচকা সার্ভ করছে, সে কথা বলতে পারে না এবং কানে শোনে না । যে দুজন বসে বসে ফুচকা বানাচ্ছে, তাদের একজন হাঁটতে পারে না আর একজন অন্ধ। আনান এই ফুচকা বিক্রির টাকা দিয়ে এই তিনটা বাচ্চা কে প্রতিবন্ধীদের স্কুলে পড়ায়। এদের পরিবার গুলো কেও আর্থিক সহায়তা করে থাকে। প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুচকা বিক্রি করে আর ছুটির দিনে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত । তারপর রাত জেগে পড়ে। আনান এর বক্তব্য হচ্ছে, সে যদি পড়ালেখা ঠিক মত করতে পারে, তাহলে সমস্যা কোথায় ? অন্যরা যে সময়ে আড্ডা দেয়, সে সময়ে যদি সে এই প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে পারে, তাহলে সেটা খারাপ হবে কেন ? ওর বাবা বলেছিল, ” সাহায্য করার টাকাটা আমার কাছ থেকে নাও। ” কিন্তু আনান রাজি হয়নি। বলেছে, ” আমি নিজে ওদের জন্য কিছু করতে চাই । ” ওর বাবা প্রথমে অমত করলেও, পরে বলেছে, ” আমি আমার ছেলের জন্য গর্বিত । ” ব্যাপারটা ঐ সময় লোকাল একটা পত্রিকাতেও এসেছিল । তারপর থেকেই সবাই এই দোকান এর ফুচকা ই খায়।
আনান এর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমি কোন দেবশিশু কে দেখছি। খুব ইচ্ছা হলো, ওর হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখি । ওর মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিই।
অনেকক্ষণ ধরে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। একজন আলোকিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মাথায় হাত দিয়ে আদর করে দিতে অস্বস্তি লাগছে । হঠাৎ আনান খেয়াল করলো আমাকে। বললো, ” আন্টি, কিছু বলবেন ? ” আমি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে ” না ” বললাম । শুধু বলতে পারলাম, ” বিলটা নাও বাবা । ” আনান ও একটু অবাক হলো। সম্ভবত ফুচকা ওয়ালা দের কেউ বাবা ডাকে না । আনান বিলটা নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো কাজে ।
ফিরে আসার সময় সারাটা পথ, আনান এর চেহারাটা চোখে ভাসছিল । মনে মনে বললাম, ” অনেক বড় হও বাবা । তোমার স্বপ্ন দেখার যে সীমা আছে, সেই সীমাকে ও ছাড়িয়ে যাও তুমি । “
লেখিকা: ডা. সুমনা তনু শিলা, রেজিষ্ট্রার, সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল , ০২/১০/২০১৯