বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আমাদের ওয়েবসাইটে স্বাগতম (পরীক্ষামুলক স¤প্রচার)

স্কটল্যান্ডে করোনা ভাইরাস (বিস্তারিত)

Sex Cams

বাংলাদেশী ব্যবসায়ীকে হত্যার দায়ে ৩ ব্রিটিশ নাগরিককে কানাডায় প্রত্যার্পণ




বাংলাস্কট রিপোর্ট (এডিনবরা, ২১ অক্টোবর ২০২৫):

সিলেটের মেধাবী তরুন শরীফ রহমান শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে পাড়ি জমায় প্রবাসে। যুক্তরাজ্যে উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন করে স্থায়ী ভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে বেছে নেয় কানাডাকে । আমেরিকার সীমান্তবর্তী কানাডিয়ান প্রভিন্স ওন্টারিও থেকে ১৯০ কিমি: দুরে ছোট্ট গ্রাম, ওয়েন সান্ড, এটি লন্ডন (কানাডা) এলাকার অন্তর্গত। ওয়েন সান্ডের দু‘পাশ ঘিরে লেক হুরন এবং অসংখ্য ঝর্না ও হারবার থাকায় শহরটি পর্যঠকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয়। শরীফ রহমান ২০১৩ সালে কানাডায় আসেন।  ২০১৫ সালে ওয়েন সান্ড শহরে বসবাস শুরু করেন সপরিবারে। চালু করেন রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা। দ্যা কারী হাউস। খুব কম সময়েই ব্যবসার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট শহরটিতে।

ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় কমিউনিটির নানা কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন শরীফ রহমান। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সরকারের অর্থনৈতিক বিভাগে নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে সেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ শুরু করেন। একাধিক চ্যারিটি সংস্থার বোর্ড মেম্বার হিসাবে যুক্ত হন শরীফ রহমান। তার একক প্রচেষ্টায় কোভিড প্যানডেমিক চলাকালে অসহায় মানুষের সাহায্যার্তে নানা কর্মসুচী পালিত হয় ওয়েন সান্ড শহরে। এখানকার জনসাধারনের  কাছে একজন কমিউনিটি হিরো হিসাবে পরিচিত লাভ করেন শরীফ রহমান। ৭ বছরের মেয়ে ও স্ত্রী শায়লা নাসরিনকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর ।

প্রতিদিনের মতই শরীফ রেষ্টুরেন্টে কাজ করছিলেন । ১৭ আগষ্ট ২০২৩ ইং তারিখে রাত নয়টার দিকে ৩ জন কাষ্টমার খাবার খেয়ে প্রায় শেষের দিকে । দুজন মধ্যবয়সী, একজন বয়সে তরুন। তরুনটির বয়স ২৪, সাথে তার বাবা ও চাচা । সবাই সাদা এবং সবাই একই পরিবারের সদস্য । খাবার শেষে বিল পরিশোধ না করে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যান তিন কাস্টমার । বিল চাইতে তাড়া করলে তরুন কাস্টমারটি শরীফকে মাথায় সজোরে  আঘাত করে । এতে অজ্ঞান হয়ে পেভমেন্টে লুটিয়ে পড়েন শরীফ । হামলাকারীরা ততক্ষনে পালিয়ে যায় । এম্বুলেস এসে হাসপাতালে নিয়ে যায় শরীফ রহমানকে। এক সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে পাঞ্চা লড়ে ২৪ আগষ্ট ২০২৩ইং পরপারে পাড়ি জমান শরীফ । হামলায় কারী হাউসের স্টাফ শরীফের ভাতিজা আদনান ও সামান্য আহত  হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন । পরে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ী ফেরেন।

একজন কমিউনিটি হিরোর অকাল মৃত্যুতে পুরো ওয়েন সান্ড শহর জুড়ে নেমে আসে শোকের ছাড়া । প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেন গোটা শহরবাসী । এখানে খুব অল্প সংখ্যক বাংলাদেশী মানুষের বাস । মেয়র, স্থানীয় প্রশাসন, বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ, মিডিয়া ও কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ শরীফ রহমানের খুনের বিচারের দাবীতে সোচ্চার হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন । নিরাপত্তা বাড়াতে শহরের অলিগলিতে অতিদ্রুত স্থাপন করা হয় সিটিটিভি। শরীফ রহমানের পরিবারের প্রতি ভালবাসার স্মারক হিসাবে স্থানীয় কমিউনিটির ৩ হাজার লোকের অনুদানে মোট ২৫০,০০০ হাজার কানাডিয়ান ডলার সংগৃহিত হয়। শরীফ রহমানের দাফনের সময় স্থানীয় মসজিদ থেকে কবরস্থানে লাশ নেওয়ার পথে রাস্তার দুপাশে শহরের জনগন সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে শেষ বিদায় জানান তাদের প্রিয় মানুষটিকে। শহরের উল্লেখযোগ্য চত্বরে শরীফ রহমানে স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি গাছ রোপন করা হয়। তাছাড়া স্থানীয় একজন বেনামী একজন ডোনার নিজস্ব অর্থায়নে ‘শরীফ রহমান মেমোরিয়েল স্কলারশীপ‘ চালু করেন। প্রতি বছর একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রকে এই স্কলারশীপ দেয়া হয়ে আসছে। স্থানীয় কাউন্সিলের উদ্যোগে কমিউনিটিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য ২০২৩ সালে তাকে ‘ওয়াইএমসিএ পিস মেডেল‘ শীর্ষক মরনোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। ওয়াইএমসিএ -র বোর্ড মেম্বার হিসাবে শরীফ রহমান গুরুত্বপুর্ন অবদান রাখেন।  শরীফ রহমান স্থানীয় জনগনের কাছে কতটা জনপ্রিয় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ওদিকে, শত চেস্টার পরেও স্থানীয় পুলিশ হামলাকারীদের খুজে বের করতে ব্যার্থ । ঘটনার ১ বছরের ও বেশী সময় আতিবাহিত হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ স্থানীয় কানাডিয়ান পুলিশ জানায় যে, এই ঘটনার দায়ে ৩ ব্যাক্তিকে অভিযুক্ত ও গ্রেফতার করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের স্কটিশ রাজধানী এডিনবরায় ।

ঘটনার বিবরনে জানা যায়, ঘটনার দিন একই পরিবারের তিনজন ব্রিটিশ নাগরিক হলিডেতে ছিলেন কানাডায় । তখন তারা উক্ত কারী হাউস রেষ্টুরেস্টে খাবার খেতে যান এবং বিল পরিশোধ না করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। উক্ত ঘঠনার পরদিন তারা ফ্লাইট ধরে কানাডা থেকে পালিয়ে ইউকে চলে আসেন।

উক্ত ঘঠনার মুল অভিযুক্ত ব্যাক্তি হলেন রবার্ট ইভান (২৪), ঘটনার সহযোগী ছিলেন তার বাবা রবার্ট বাসবি ইভান (৪৭) ও  চাচা ব্যারী ইভান (৫৪) । এডিনবরার পার্শ্ববতী ডালকিথ এলাকা থেকে ২০২৪ সালের শেষ দিকে কানাডা সরকারের অনুরোধে স্কটিশ পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে। এই তিন জন্ হলেন ট্রাভেলার্স কমিউনিটির সদস্য বলে জানা গেছে । তারা ফেইক ব্রিটিশ পাসপোটে নাম বদল করে ভিজিট ভিসায় কানাডায় প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে তারা অবৈধভাবে রাজমিস্রির কাজ করতেন । ক্যাশ পেমেন্টে গ্রহন করে স্বল্পমুল্যে বিভিন্ন কাজ যেমন; পেভমেন্ট, কারপার্ক কিংবা গার্ডেন মেরামত ইত্যাদি কাজ করতেন।

এডিনবরা শেরিফ কোর্টে কয়েকদিন ধরে শুনানী শেষে গত ২০ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে অভিযুক্ত তিন ব্যাক্তিকে বিচারের মুখোমুখি হতে কানাডায় প্রত্যাপর্তন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । প্রত্যপর্তন (এক্সাডিশন) সিদ্ধান্তে অভিযুক্ত তিন ব্যাক্তি সম্মতি প্রদান করেছেন বলে জানা গেছে। তবে কত তারিখ প্রত্যাপর্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।

উল্লেখ্য, শরীফুলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেটের বটেশ্বর এলাকায়। তিনি জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সিলেট সরকারী কলেজ থেকে উচ্ছ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ২০০১ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন। ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো থেকে ফাইন্যান্স এন্ড ডেভলাপমেন্ট ইকনমিক্সে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ থেকে ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশন্যাল ডেভলাপমেন্ট বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন।

প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটি  মনে করেন শরীফ রহমান ছিলেন বাংলাদেশী কমিউনিটির অহংকার তথা মাইগ্রান্ট কমিউনিটির পজিটিভ রোল মডেল। সবার দাবী হল অপরাধী যে দেশের ই হোক না কেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে অবিলম্বে দৃষ্টান্তুমুলক শাস্তি প্রদান করা হোক। সুবিচার প্রতিষ্টিত হলে শরীফ রহমানের পরিবার ও তার বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। স্বস্থি পাবেন ওয়েন সান্ডের হাজারো মানুষ যাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল এক বাংলাদেশী – শরীফ রহমান।

রিপোর্ট: মিজান রহমান, বাংলাস্কট নিউজ

সম্পাদক: মিজান রহমান
প্রকাশক: বিএসএন মিডিয়া, এডিনবরা, স্কটল্যাণ্ড থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: